বাংলায় একটি বাগধারা আছে ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ – যা ব্যবহৃত হতো অসম্ভব বা অবাস্তব কোন বস্তু বোঝাতে।
তবে বহু পুরোনো এই প্রবচন হয়তো এখন অযৌক্তিক প্রমাণিত হবার সময় এসে গেছে – কারণ কাঁঠাল থেকে আমের মতই ‘সত্ত্ব’ তৈরি করা এখন আর অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশের কৃষিবিদরা এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন ‘কাঁঠালসত্ত্ব।’
প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ কাঁঠাল ব্যবহার করে এরকম পণ্য আগেই উৎপাদন করেছে। তবে বাংলাদেশে কাঁঠাল থেকে এ ধরণের খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে এই প্রথম।
শুধু কাঁঠালসত্ত্ব নয়, কাঁঠাল ব্যবহার করে গবেষণাগারে ভেজিটেবল মিট, চিপস, আচার, জেলি, আইসক্রিম, কেকসহ বিভিন্ন ধরণের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদরা।
কাঁঠালের অপচয় রোধে এবং এই ফলের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি অধিদপ্তরের ‘কাঁঠাল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, পদ্ধতি ও বাজারজাতকরণ’ প্রকল্পের অধীনে তৈরি হচ্ছে এসব খাদ্য পণ্য।
এই প্রকল্পের প্রধান ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্ট-হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী জানান, কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত দুই বছর ধরে এই গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশে।
“এই প্রকল্প সফল হলে কাঁঠালের অপচয় তো রোধ হবেই, পাশাপাশি এসব পণ্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং স্বল্প বিনিয়োগে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে” – আশা প্রকাশ করছেন মি. চৌধুরী।

কাঁঠাল নিয়ে কেন গবেষণা?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপন্ন হয়।
“আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, গত কয়েক বছর এই মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫%, অর্থাৎ প্রায় ৫ লক্ষ টন কাঁঠালই নষ্ট হয়েছে”, বলেন মি. ফেরদৌস চৌধুরী।
কাঁঠালের মৌসুমে একইসাথে আম, লিচু, জামের মত ফল বাজারে থাকা এবং এসব ফলের তুলনায় খাওয়ার জন্য কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর বলে প্রতি বছরে উৎপাদিত কাঁঠালের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে কাঁচা কাঁঠাল খাওয়ার চল না থাকাও অপচয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

“বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, কাঁঠাল শুধু পাকাই খাওয়া যায়। আবার আম খাওয়ার জন্য মানুষের যে ঝোঁকটা রয়েছে, কাঁঠাল পছন্দ করলেও সেটির জন্য ঐ ঝোঁক দেখা যায় না মানুষের মধ্যে।”
“আবার কাঁঠাল ভাঙ্গার ঝামেলা, খাওয়ার সময় হাতে-মুখে আঠা লেগে যাওয়ার বিড়ম্বনার জন্য নতুন প্রজন্মের অনেকে পাকা কাঁঠাল পছন্দ করলেও শখ করে খেতে চায় না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই কাঁঠাল দিয়ে এমন খাদ্যদ্রব্য তৈরির চেষ্টা করছি আমরা, যেটা সহজে খাওয়া যায় এবং সুস্বাদুও”, বলেন ফেরদৌস চৌধুরী।
কাঁঠাল ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে যেসব পণ্য
কৃষিবিদ ফেরদৌস চৌধুরী জানান তাদের গবেষণাগারে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলোর একটা বড় অংশ তৈরি করা হয় কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে।
“কাঁচা কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করে ভেজিটেবল মিট তৈরি করা হয়েছে, যেটিকে ‘ফ্রেশ কাট’ বলা হয়। এই পণ্য এরই মধ্যে ঢাকার কয়েকটি সুপার শপে বিক্রি হচ্ছে এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে এটি সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।”
কাঁঠাল দিয়ে তৈরি এ ধরণের ভেজিটেবল মিট কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া সরাসরি রান্না করা যায় এবং দামে সাশ্রয়ী বলে এটি গ্রাহকের কাছে সাড়া ফেলছে বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।
এছাড়া কাঁচা কাঠাল কেটে, মসলা দিয়ে, প্রক্রিয়াজাত করে, শুকিয়ে, প্যাকেটজাত করে কাঁঠালের ‘ড্রাইড’ প্রডাক্ট তৈরি করা সম্ভব, যা সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়।

পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে চাটনি ও উৎকৃষ্ট মানের আচারও নারী উদ্যোক্তাদের অনেকে বাজারজাত করছেন বলে জানান মি. চৌধুরী।
“এছাড়া কাঁঠাল থেকে উৎকৃষ্ট মানের চিপস, জ্যাম, জেলি ছাড়াও অত্যন্ত সুস্বাদু কাঁঠালসত্ত্ব তৈরি হয়, যেটিকে আমরা জ্যাকফ্রুট লেদার বলে থাকি।”
এছাড়া কাঁচা কাঁঠালের ভেজিটেবল রোল, কাটলেট, সিঙ্গাড়া, সমুচা ছাড়াও পাকা কাঁঠালের রস দিয়ে আইসক্রিম বা কেকের মত খাবার তৈরি করা যায় বলে জানান মি. চৌধুরী।
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
কাঁঠাল ব্যবহার করে তৈরি এসব পণ্য এরই মধ্যে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও এসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
মি. চৌধুরী জানান চলমান এই প্রকল্পের অধীনে ২৫০ থেকে ৩০০ জন কৃষি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে বাজারজাত করছেন।
“আমাদের উদ্দেশ্য তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করা, যেন তারা এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। তাদের মাধ্যমে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র পরিসরে আরো কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি।”
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম সহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে কাঁঠাল দিয়ে তৈরি নানা ধরণের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেসব দেশে কাঁঠালজাত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।
“আমাদের দেশের কাঁঠাল খুবই উৎকৃষ্ট মানের, কাজেই এই কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা খাদ্য আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয় হতে পারে বলে আমাদের ধারণা।”